সুন্দরবনের ৬২ শতাংশ এলাকায় বনজ সম্পদ বেড়েছে
তবে সমীক্ষা অনুযায়ী, সুন্দরবনের ৩২ শতাংশ এলাকায় বনজ সম্পদের পরিমাণ কমেছে। মূলত পাশে মানববসতি আছে এমন এলাকায় বনজ সম্পদের পরিমাণ কমেছে। আর বনের যে অংশে নদী ও বঙ্গোপসাগর, সেই অংশে বনজ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে।
সুন্দরবনের গাছের সংখ্যা ও কার্বন শুষে নেওয়ার সক্ষমতা জানতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বনসেবা বিভাগের কারিগরি সহযোগিতায় বাংলাদেশ বন বিভাগ পাঁচ মাস ধরে এই সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত ১৩ বছরে সুন্দরবনের গাছ, লতা-গুল্ম ও বনজ সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে। সুন্দরবনের বঙ্গোপসাগর ও নদীতীরবর্তী অংশে গাছের সংখ্যা ৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলার সুন্দরবন অংশে গাছের পরিমাণ ৩ শতাংশ কমেছে।
এক যুগ ধরে সুন্দরীগাছের আগা-মরা রোগ নিয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। এ বিষয়ে স্বস্তিদায়ক তথ্য দিয়েছে সমীক্ষাটি। এতে দেখা গেছে, মাত্র ৩ শতাংশ সুন্দরীগাছে আগা-মরা সমস্যা প্রকট। বাকি এলাকায় সুন্দরীগাছ ভালোভাবেই বেড়ে উঠছে।
সহকারী বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ ও যুক্তরাষ্ট্রের বনসেবা বিভাগের প্রতিবেশ গবেষক ড্যানিয়েল সি ডোনাটোর নেতৃত্বে কার্বনের পরিমাণ নির্ধারণ সমীক্ষা: ২০০৯-১০ পরিচালিত হয়। এই সমীক্ষার কার্বন-সংশ্লিষ্ট অংশটি সম্প্রতি জাতীয় সংসদে তথ্য আকারে প্রকাশ করা হয়।
সমীক্ষা অনুযায়ী, সুন্দরবনের লোকালয়সংশ্লিষ্ট এলাকায় বনজ সম্পদ কমছে। এসব এলাকার বনজ সম্পদ রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, বিশেষ করে সিডর-আইলার পর সরকারের পরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে বনের উল্লেখযোগ্য অংশে সম্পদ বেড়েছে। লোকালয়সংশ্লিষ্ট যেসব এলাকায় সমস্যা আছে সেখানে, নির্দিষ্ট করে বললে বনসংলগ্ন ৯৭ গ্রামের মানুষকে নিয়ে বন বিভাগ সহব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চালু করছে। ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় তা চালুও হয়েছে। এ ছাড়া উন্নয়ন-সহযোগীদের সহায়তায় বনের পাশে বসবাসকারী মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, এতে এসব এলাকায় বনজ সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
অপরাজেয় সুন্দরবনের শক্তি: সমীক্ষায় বলা হয়, ২০০৭ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণে সুন্দরবনের নদী ও সমুদ্রসংলগ্ন এলাকায় বেশি ক্ষতি হয়েছিল। বসতি এলাকায় আসতে আসতে ঝড় দুটি দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
সিডর ও আইলার পর আবহাওয়া বিভাগ সিডরের গতিপথ ব্যাখ্যা করে বলেছিল, সুন্দরবন না থাকলে সিডরের ধাক্কা লাগত খোদ রাজধানী পর্যন্ত। সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে সিডরের গতি প্রতি ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার থেকে কমে ২০০ কিলোমিটারের নিচে নেমে গিয়েছিল। নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে সুন্দরবন রক্ষা করেছিল মানুষের জীবন ও সম্পদ।
প্রকৃতিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) ঘূর্ণিঝড় আইলার পর একটি তাৎক্ষণিক সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছিল, সুন্দরবনের কারণে আইলার বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা চার ফুট কমে গিয়েছিল।
সিডর ও আইলার পর সুন্দরবন নিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বন বিভাগের হিসাবে, সিডরে সুন্দরবনের ২৫ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, বনের প্রতিবেশব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। অনেকে বলেছিলেন, সুন্দরবন এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে না। উপড়ে পড়া গাছের সারি আর ঝলসে যাওয়া গোলপাতা দেখে অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে এর মধ্যে নতুন করে গাছ লাগাতে হবে। পড়ে যাওয়া গাছ কেটে ফেলতে হবে। গাছকাটার দরপত্র আহ্বানের জন্যও ছোটাছুটি শুরু করে একটি পক্ষ। ওই সময় বিদেশের অভিজ্ঞতা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, ‘সুন্দরবনকে বিরক্ত করবেন না’। ২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর বন বিভাগ ভেঙে যাওয়া গাছ না কাটার সিদ্ধান্ত নেয় এবং গোলপাতা ও মধু আহরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আরেকটি বর্ষা যেতে না-যেতেই সুন্দরবন এই সিদ্ধান্তের ন্যায্যতা প্রমাণ করে। সবুজ-সতেজ সুন্দরবন জানিয়ে দিয়েছিল, সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
ঝড়ের পরের সম্ভাবনা: বন বিভাগের এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত ১৩ বছরে সুন্দরবনে চারা গজানো এবং তা থেকে পরিপূর্ণ বৃক্ষে পরিণত হওয়ার পরিমাণও বেড়েছে। ২০০৯ সালে ৫৩ হাজার ৮০৬ হেক্টর জমিতে নতুন চারা গজিয়েছে। ’৯৬ সালে নতুন চারা গজিয়েছিল ৩৪ হাজার ৬২৩ হেক্টর জমিতে; বিশেষ করে, সুন্দরবনের সবচেয়ে শক্তিশালী বৃক্ষ সুন্দরী, গেওয়া, বাইনগাছের পরিমাণ বেড়েছে আগের তুলনায়।
দুটি ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত আর গাছচোরদের উৎপাতের পরও সুন্দরবনের বনজ সম্পদের পরিমাণ কেন বাড়ল, এই প্রশ্নের জবাবে সমীক্ষার তত্ত্বাবধায়ক ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সিডর ও আইলার আঘাতে সুন্দরবনে অনেক পুরোনো ও বড় গাছ ভেঙে পড়েছিল। এতে ছোট ও নতুন গাছের বেড়ে ওঠার মতো আলো-বাতাস ও জীবনীশক্তি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভাঙা গাছ না কাটার ফলে পড়ে থাকা গাছের ডাল-পাতা পচে বনের মাটিকে উর্বর করেছে। এতে টিকে থাকা গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠেছে। চারা গাছ পরিণত হওয়ার পরিমাণ বেড়েছে।
জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলের সদস্য অধ্যাপক আতিক রহমান এ ব্যাপারে বলেন, ‘সুন্দরবনকে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিয়ে একে মানুষের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। সুন্দরবন থেকে সম্পদ আহরণের চিন্তা বাদ দিতে হবে। একে সংরক্ষণ করলে ভবিষ্যতে তা বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় থেকে আমাদের রক্ষা করবে।’ প্রকৃতি ও বন থেকে মানুষ এভাবেই সেবা নিতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
সুন্দরবনের যত সম্পদ
১৯৯৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের এক লাখ ৪৩ হাজার হেক্টর এলাকাকে বন্য প্রাণীর জন্য অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পূর্ব সুন্দরবনের নীলকমল, পশ্চিমের নোটাবেটী ও দক্ষিণের নীলকমলের এই এলাকায় সব ধরনের সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৭ সালে সিডরের পর সরকার আবারও সুন্দরবনে গোলপাতা ও মধু ছাড়া সব ধরনের সম্পদ আহরণ বন্ধ করে দেয়।
বন বিভাগের সর্বশেষ জরিপে বলা হয়েছে, সুন্দরবনে ৩১৫ প্রজাতির পাখির বাস। এর মধ্যে ৮০ প্রজাতি অতিথি পাখি। রয়েছে ৪০০ প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী। আছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড। এখানে সুন্দরী, কেওড়া, গরান, গোলপাতা, পশুর, কাঁকড়া, হেতাল, বলা, সিংড়া ও খলসীগাছ বেশি জন্মে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য বিখ্যাত হলেও এ বনে ৩৭৫ প্রজাতির বেশি বন্য প্রাণী রয়েছে, যার মধ্যে ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩১৫ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৯১ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা। লোনা পানির কুমির, বন্য শূকর, বানর, ডলফিন, মেছো ও বনবিড়াল ও বিখ্যাত চিত্রল হরিণ হামেশাই দেখা যায় সুন্দরবনে। ২০০৪ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) জরিপ অনুযায়ী, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ৪৪০টি।
No comments:
Post a Comment