CRICKET LIVE STREAMING

Wednesday, September 15, 2010

ছোট পর্দার ঈদ আয়োজন : একটি সোনালি রুপালি পোস্টমর্টেম

ছোট পর্দার ঈদ আয়োজন : একটি সোনালি রুপালি পোস্টমর্টেম


ঈদ নিয়ে দর্শককে বিনোদিত করতে যে বর্ণাঢ্য পসরার আয়োজন করেছে চ্যানেলগুলো, তাতে দর্শক কতটুকু বিনোদিত হবেন সেটা নিয়ে চ্যানেল কর্তারা খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন বলে মনে হয় না। বরং কোন চ্যানেল কত দিনব্যাপী তাদের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে সেদিকেই বোধকরি খেয়াল ছিল বেশি। যে কারণে অতি সাদামাটা অনুষ্ঠানকেও বিশেষ বলে চালিয়ে দিয়েছে বেশিরভাগ চ্যানেল। বিটিভির দর্শক এখনও যে কোনো চ্যানেলের তুলনায় ঢের বেশি। যে কারণে তাদের ঈদ আয়োজনও হয় দীর্ঘদিনব্যাপী। তবে এবারের ঈদ আয়োজনেও দেখা গেছে মানের চেয়ে মাননীয়দের প্রতি বিটিভির আগ্রহ বেশি। যে কারণে মানসম্পন্ন অনেক অনুষ্ঠানকে ঈদের ছুটির শেষের দিকে প্রচার করা হয়েছে। আর ঈদের ছুটিতে পিকআওয়ার বলে গণ্য দিনক্ষণে প্রচার হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নির্মিত সব অনুষ্ঠান। এ ধারা থেকে বিটিভি বের হতে পারছে না বলেই হয়তো এখনও পর্যন্ত বিটিভির ঈদ আয়োজন নিয়ে কোনো হৈ চৈ হয় না। এবারও যথারীতি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোই এগিয়ে ছিল মান আর দর্শক চাহিদার নিরিখে। ঈদের বিশেষ আয়োজন এখনও শেষ হয়নি। চতুর্থ দিন শেষ হয়েছে মাত্র। আর চারদিনের টিভি অনুষ্ঠান দেখে সহজেই বোঝা গেছে, দর্শক চাহিদা পূরণ নয়, বরং সংখ্যাধিক্যের প্রতিই সবার আগ্রহ ছিল বেশি। ঈদকে ঘিরে চ্যানেলগুলোর চারদিনের বিশেষ আয়োজনের পোস্টমর্টেম করেছেন আনিকা হোসেন

প্রভাবশালীদের মন রক্ষায় বিটিভি এবারও রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। কেননা বিটিভিতে গত চারদিনে যতগুলো নাটক বা প্যাকেজ অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে তার প্রায় শতভাগই প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নির্মিত। কোনো নাটক বা অনুষ্ঠানে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম না থাকলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর সবই কোনো না কোনো সরকারদলীয় প্রভাবশালী বলয় থেকে প্রচার হচ্ছে। বিশেষ করে অনুষ্ঠানগুলোর সংবাদ প্রকাশের জন্য পত্রিকা অফিসে যেসব স্তর থেকে অনুরোধ এসেছে তা থেকেই সহজে অনুমান করা যায়, বিটিভির ঈদ আয়োজন এবারও ছিল প্রভাবশালীদের কব্জায়। প্রভাবশালীদের যেসব অনুষ্ঠান এবার প্রচার হয়েছে তা ছিল যাচ্ছেতাই। নিজের পরিচিতি আর পকেটপ্রীতি ছাড়া দর্শক এসব নাটক বা অনুষ্ঠানে আর কিছু দেখেনি। তবে বিটিভি এবারও উের গেছে হানিফ সংকেতকে দিয়ে। তার ইত্যাদিই ছিল বিটিভির সেরা অনুষ্ঠান। শুধু বিটিভি বললে ভুল হবে গত চারদিনের ঈদ আয়োজনের সেরা বিনোদন হিসেবে এখনও ইত্যাদির নামই সবার আগে আসবে। বর্ণাঢ্যতা, ব্যাপকতা, চমক আর মানের বিচারে ইত্যাদির ঈদ আয়োজন ছিল দৃষ্টিনন্দন। যে কারণে নন্দিত নির্মাতা শব্দটি মনে হয় কেবল তার বেলাতেই মানায়। পাশাপাশি বিশেষ আয়োজনের যে বহর তাও কেবল ইত্যাদির মতো হাতেগোনা কয়েকটি আয়োজনের ক্ষেত্রেই মানানসই। সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক বিদ্রূপ আর জমকালো আয়োজন ইত্যাদিকে নিয়ে গেছে অতি উচ্চতায়। বিশেষ করে ইত্যাদির সামাজিক দায়বদ্ধতার সফল চিত্র আবারও দেখা গেছে অনুষ্ঠানের প্রতিটি ফ্রেমে। ইত্যাদির এ সফলতায় বিটিভির আর কোনো আয়োজন নিয়ে কথা বললে জনপ্রিয় এ আয়োজনকে ছোট করা হবে। তবে একটি কথা না বললে পাঠক আর দর্শক মহল খুশি হবেন বলে মনে হয়। জনপ্রিয় আর দর্শকনন্দিত এ অনুষ্ঠানটি কেন ঈদের তৃতীয় দিন রাত সাড়ে ১০টায় প্রচার হলো এটা একটি বড় প্রশ্ন? শোনা গেছে, বিটিভি অনুষ্ঠানের মান নির্ধারণ করে প্রচারের দিনক্ষণ ঠিক করে। তাই যদি হয় তাহলে ঈদের দ্বিতীয় দিন যেসব প্যাকেজ অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে তার মান কি ইত্যাদি’র চেয়ে ভালো ছিল? বিটিভির প্যাকেজ প্রিভিউ কমিটির কাছে এই প্রশ্ন এলে নিশ্চিত তার আমতা আমতা করবেন! প্রতিবারই ঈদের ইত্যাদি প্রচার হয় ঈদের দ্বিতীয়দিন রাত ৯টায়। এবার কেন তার ব্যতিক্রম হলো? কেন দর্শক তাদের প্রিয় অনুষ্ঠানটি ঈদের ছুটিতে দেখতে পেলেন না? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো দায়িত্বশীল কেউ দিতে পারবেন না! তবে হানিফ সংকেত শুধু ইত্যাদির চমকেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। এটিএন বাংলায় প্রচার হয়েছে তার রচনা ও পরিচালনায় নাটক ঠিক-ঠিকানা এবং তার ফাগুন অডিও ভিশন থেকে একই চ্যানেলে প্রচার হয়েছে পাঁচফোড়ন। নাটক এবং ভিন্নধর্মী এ অনুষ্ঠান দুটিও দর্শক উপভোগ করেছে প্রাণ ভরে। বিনোদনের সব বিষয়ই এ দুটি অনুষ্ঠানে ছিল। ছিল না কেবল জোর করে হাসানোর চেষ্টা। যে ঘটনাটি এবার প্রায় প্রতিটি নাটকেই ঘটেছে। যেহেতু ঈদে কোনো চ্যানেলেই ইত্যাদি’র মতো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নেই, সেহেতু এটাকে সেরা আয়োজন বলা যায় কোনো যুক্তিতর্ক ছাড়াই। তবে হানিফ সংকেতের নাটক সেরা নাটক ঠিক এ মুহূর্তে বলা যাবে না। তবে বোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা করে বলা যায়, গত চারদিনের আয়োজনে এটাই ছিল অন্যতম সেরা নাটক। তাছাড়া গত চারদিনে প্রচার হওয়া প্রায় একশ’ নাটকের সবক’টি দেখে মান বিচার করা অসম্ভব। যে কারণে বেছে বেছে প্রত্যাশিত অনুষ্ঠানগুলোই দেখেছেন বোদ্ধা থেকে শুরু করে সাধারণরা। আর এই বাছাই প্রক্রিয়ায় নাটকের ক্ষেত্রেও যে হানিফ সংকেত অনন্য বা নিরূপম তা একবাক্যে স্বীকার করেছেন সবাই।
স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর মধ্যে মানের বিচারে এবারও এনটিভি ছিল শীর্ষে। তাদের আয়োজনের পরিমিতিবোধ আর সূক্ষ্ম হিসেব দর্শককে মুগ্ধ করেছে। আর এজন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন এ চ্যানেলটির কর্তাব্যক্তিরা আর অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ। এনটিভি এবারের ঈদে যেসব নাটক প্রচার করেছে তার মধ্যে হুমায়ূন আহম্মেদের নাটকের প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকলেও তিনি সুনাম ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং অনেক তরুণ নির্দেশক অনেক ভালো কাজ উপহার দিয়েছেন। এনটিভির সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল পরিমিতিবোধ আর বাছাই প্রক্রিয়ায়। অন্যান্য চ্যানেলে দেখা গেছে একই অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাটক পরপর প্রচার হচ্ছে। সুতরাং বিজ্ঞাপন আধিক্যে কখন কোন নাটক শেষ হচ্ছে আর কোনটি শুরু হচ্ছে তা বোঝা দায় ছিল। সেক্ষেত্রে এনটিভি একই শিল্পী অভিনীত নাটক একই দিনে প্রচার করেনি। যে কারণে দর্শক বিভ্রান্তও হয়নি। বিটিভির পরই সংখ্যা আর দিনের হিসেবে সবচেয়ে বড় আয়োজনটি উপহার দিতে যাচ্ছে এটিএন বাংলা। গত চারদিনে তাদের আয়োজনে একমাত্র হানিফ সংকেতের নাটক ছাড়া খুব বেশি ভালো কাজ এ চ্যানেলটিতে তেমন একটা দেখা যায়নি। চ্যানেল আই এবারও অনেক অগোছালো আয়োজন উপহার দিয়েছে। তবে কিছু কিছু নাটক এবং বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান দর্শক উপভোগ করেছে। অন্যান্য চ্যানেলের আয়োজন নিয়ে কথা না বলাই ভালো। নতুন চ্যানেল হিসেবে দেশটিভি এবার বেশ চমক সৃষ্টি করেছে। সাতদিনের বিশেষ আয়োজনে সাতটি রং আর সাতটি বিষয়কে নিয়ে তাদের বিশেষ আয়োজন এখনও পর্যন্ত ভালো লেগেছে। নতুনত্ব ছিল বেশিরভাগ আয়োজনে। সাতদিনে সাতজন নারী নির্মাতার নাটক প্রচারও দর্শককে আকৃষ্ট করেছে।
এবারের ঈদ আয়োজনে একটি নতুন ধারা লক্ষ্য করা গেছে। অনেক নাটকেই সংলাপে অশ্লীলতা আর উপস্থাপনায় কুরুচির ছাপ ছিল স্পষ্ট। বিশেষ করে নাটকের নাম নির্বাচনে কুরুচির পরিচয় পাওয়া গেছে। মামুনুর রশীদের মতো বরেণ্য নির্মাতাও ঈদের নাটকের নাম দিয়েছেন ‘ঠ্যাটারু’। এবারের ঈদের নাটকের নামের মধ্যে আরও আছে ঝগড়ালি, আই লাভ ইউ তিনটি কারণে, নাটক শেষ ভালোবাসা শুরু, বেড়া খেত খায় ইত্যাদি। এগুলো কোন রুচিবোধের নাটক তা বিচারের দায়িত্ব দর্শকের ওপরই ছেড়ে দিলাম। আর একটি মজার বিষয় লক্ষ্য করা গেছে, অনেক নাটকেই শিল্পীদের দেখা গেছে এলোমেলোভাবে সংলাপ বলতে। নাটকের দৃশ্যায়ন আর শিল্পীদের সংলাপ বলার ভঙ্গি দেখে মনে হয়েছে স্ক্রিপ্ট ছাড়াই কাজ করেছেন অনেকে। ঈদের আয়োজনে সেই পুরনো প্রবণতাটাও রয়ে গেছে ব্যাপকভাবে। ঈদ মানেই কেবল নাটক আর টেলিফিল্মে সীমাবদ্ধ ছিল প্রতিটি চ্যানেল। বৈচিত্র্যময় কাজ আর নতুন ধারার আয়োজন এবারও কোনো চ্যানেলে দেখা যায়নি। সকালে সিনেমা, দুপুরে টেলিফিল্ম, বিকালে নাটক আর রাতে পরপর দু’তিনটি নাটক। ব্যাস। ফাঁকে কেবল কয়েকটি গানের অনুষ্ঠান আর মিউজিক ভিডিও’র মতো তার উপস্থাপনা। এই ছিল ঈদ আয়োজনের প্রবণতা, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।
বিজ্ঞাপনের হাল এবারও অনুষ্ঠানমালাকে বেহাল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এনটিভি বেশ কয়েক বছর আগে বিশেষ বিশেষ নাটককে ঘোষণা দিয়ে মাত্র একটি বিজ্ঞাপন বিরতির মাধ্যমে প্রচার করে প্রশংসিত হয়েছিল, যা পরে চ্যানেল আই’ও অনুসরণ করেছিল। কিন্তু এবার এ ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি কোনো চ্যানেলে। সুতরাং বিজ্ঞাপনের ঠেলায় এবারও দর্শক কোনো আয়োজন মন ভরে উপভোগ করতে পারেনি। রিমোটের বোতাম চাপলে যত না দেখা গেছে অনুষ্ঠান, তার চেয়ে ঢের বেশি সময় দেখা গেছে বিজ্ঞাপন।
বছরজুড়ে যতগুলো নাটক, টেলিফিল্ম বা অন্যান্য অনুষ্ঠান দেখা যায় টিভি চ্যানেলে, তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দেখা যায় ঈদ আয়োজনে। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে সীমাহীন এ আয়োজনকে কী আর বিশেষ আয়োজন বলা যায়? তবে চ্যানেলগুলোকে ধন্যবাদ—তারা ঈদের সময় সংবাদকে বিশেষ বলে সম্বোধন করেনি। আর এত বিশেষ আয়োজনের মাঝে সত্যিকার অর্থে বিশেষ কাজটিকে খুঁজে নিতে দর্শক যে বিব্রত হতে পারেন বা বিভ্রান্ত হয়েছেন তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে ঈদ আয়োজনের এই বিশাল পসরা দর্শকের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। ঈদের ছুটি তিনদিন হলেও সর্বোচ্চ আট দিনব্যাপী যে আয়োজন উপহার দেয়া হয়েছে তাতে আর ছুটির আমেজ থাকেনি। একটা সময় ছিল যখন ঈদের ছুটিতে সবাই টিভি সেটের সামনে থাকত। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বিনোদন কেন্দ্রগুলোও ফাঁকা থাকত। কিন্তু এখন হয়েছে উল্টোটা। বিনোদন কেন্দ্র আর রাস্তাঘাটের আড্ডাই ঈদের ছুটিতে বেশি চোখে পড়ে। আর টিভি সেট থাকে বন্ধ। কেবল নন্দিত কিছু নির্মাতার কাজ সময় বের করে দেখেন অবসর কাটানো আর সারাদিনের পরিশ্রম থেকে ক্লান্তি দূর করার জন্য। আর এই চিত্রের জন্য দায়ী কেবল অনুষ্ঠানের আধিক্য। যে কারণে অনেক তরুণ মেধাবী নির্মাতা ভালো কাজ করলেও তা চোখে পড়ে না বোদ্ধা থেকে শুরু করে সাধারণের। সবাই নন্দিতদের পেছনে ছুটে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হতাশ হলেও মেধাবীরা বঞ্চিত হয়েই যাচ্ছে। যে কারণে টিভি ব্যক্তিত্বরা একবাক্যে বলেছেন, ঈদ আয়োজনের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা তিনদিনের বেশি হওয়া সমীচীন নয়। কিন্তু তাতে করে চ্যানেলগুলোর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে কারণে দর্শকের কথা মাথায় না রেখে নিজেদের হিসাব-নিকাশগুলোকেই এসব বিশেষ আয়োজনে প্রাধান্য দিয়ে আসছে চ্যানেলওয়ালারা। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দর্শক পছন্দ নয়, তাদের পছন্দ আর ইচ্ছেকেই বরাবর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেখলে দেখ, না দেখলে নাই। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে হয়তো বিশেষ শব্দটি আর কোনো বিশেষ মাহাত্ম্য বহন করবে না।

No comments:

Post a Comment

kazi-music