পবিত্র রমজান মাসে এশার ফরজ ও সুন্নত নামাজের পরে, বিতরের নামাজের আগে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয় তা-ই তারাবির নামাজ। এটি সুন্নতে মোয়াক্কাদা। রাসুল (সা.) মাত্র তিন রাত এ নামাজ আদায় করেছিলেন। আবার কোনো কোনো রেওয়ায়েতে এক রাত কিংবা দুই রাতের কথাও উল্লেখ আছে। তবে কোন তিন রাতে রাসুলে পাক (সা.) এ বিশেষ নামাজ আদায় করেছিলেন সে বিষয়ে হজরত আবু যর গিফারি (রা.) বর্ণনা করেন_'আমরা রাসুলে পাক (সা.)-এর সঙ্গে নিয়মিত নামাজ আদায় করতেছিলাম। যখন ২৩ রমজান আসলো, তখন তিনি আমাদের নিয়ে বিশেষ নামাজ পড়লেন। এতে রাতের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় হয়। ২৪ রমজান তিনি হুজরা মোবারক থেকে বের হলেন না, ২৫ রমজান তিনি হুজরা থেকে বের হয়ে আমাদের নিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত নামাজ পড়লেন। ২৬ রমজান তিনি হুজরা থেকে বের হলেন না। এরপর ২৭ রমজান তিনি আমাদের নিয়ে আবার সারা রাত নামাজ পড়লেন।'
পরবর্তী সময়ে সাহাবিরা মসজিদে নববীতে ওই বিশেষ নামাজ পড়ার জন্য অপেক্ষমাণ থাকলেও রাসুলে পাক (সা.) হুজরা মোবারক থেকে বের হননি। সাহাবায়ে কেরাম এর কারণ জিজ্ঞেস করলে নবীজী (সা.) এরশাদ করেন_'আমি যদি ওই নামাজের জন্য বের হতাম তাহলে তোমাদের ওপর ফরজ হয়ে যেত।' তাই রাসূলে পাক (সা.) এ নামাজ আর আদায় করেননি। শুধু তাই নয়, তারাবিবিহীন অবস্থা চলতে থাকে হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনকাল পর্যন্ত।
হজরত ওমর (রা.) তাঁর শাসনামলে প্রখ্যাত সাহাবিদের নিয়ে শলাপরামর্শ করে ২০ রাকআত তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করার বিধান জারি করেন। এ থেকে বোঝা যায়, তারাবির নামাজ ২০ রাকাত জামাতের সঙ্গে আদায় করা বেদআত। তবে এটি 'বেদআতে হাসানা' বা উত্তম বেদআত যা ফারুকে আযম (রা.) সবাইকে পালন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
যে নামাজ রাসুলে পাক (সা.) জামাতে পালন করলেন না, এমনকি হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর আমলে যে নামাজ পালিত হলো না, ওমর (রা.) কেন তা চালু করলেন?_এ প্রসঙ্গে হজরত আলী (রা.) বলেন, 'হজরত ওমর (রা.) আমার মুখে একটি হাদিস শুনে তারাবির নামাজ আনুষ্ঠানিকভাবে আদায় করার সিদ্ধান্ত নেন।' হাদিসটি সম্পর্কে হজরত আলী (রা.) বলেন, 'আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ পাকের আরশের নিচে একটি নূরের মহল (হাজিরাতুল কুদস) রয়েছে। সেখানে অগণিত ফেরেশতা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকেন। যখন রমজান মাসের আগমন ঘটে তখন তারা আল্লাহর হুকুমে দুনিয়ার জমিনে অবতরণ করেন এবং মুসলি্লদের সঙ্গে তারাবির নামাজে শরিক হন। উম্মতে মোহাম্মদীর যারা ওই ফেরেশতাদের সঙ্গে মুসাফাহ করবেন অথবা ফেরেশতারা যেসব মুসলি্লর সঙ্গে মুসাফাহ করবেন তাঁরা এমন সৌভাগ্যবান হয়ে যাবেন যে, ভবিষ্যতে আর কখনো ভাগ্যহীন হবেন না।'
বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে দুই ধরনের তারাবির নামাজ আদায় হতে দেখা যায়। গ্রামের মসজিদগুলোতে সাধারণত ছোট সুরা দিয়ে তারাবির নামাজ আদায় করা হয় এবং শহরের বেশির ভাগ মসজিদেই খতম তারাবি অনুষ্ঠিত হয়। উভয় পদ্ধতিতেই তারাবির নামাজ আদায় হয়ে যায়। তবে নামাজে পূর্ণ এক খতম কোরআন পড়া সুন্নত। জামাতে লোকের কষ্ট হলে বা জামাতে লোক কমে গেলে ছোট সুরা দিয়ে তারাবি পড়াই ভালো। তারাবির শাব্দিক অর্থ হলো আরাম ও বিশ্রাম লাভ করা। কাজেই এ ক্ষেত্রে প্রতি চার রাকাত নামাজের পর পরই বিশ্রাম নেওয়া হয় এবং বিশেষ দোয়া করা হয়। ২০ রাকাত তারাবির নামাজই শেষ করা হয় এ নিয়মতান্ত্রিক বিরতি প্রক্রিয়ায়। এতে করে এক প্রাণবন্ত ও বরকতময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কিন্তু অতি দ্রুততার সঙ্গে তারাবির নামাজ সম্পন্ন করার প্রবণতা আমাদের দেশে প্রায়ই লক্ষ করা যায়। অথচ মক্কা-মদিনাসহ পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশেই এ নামাজ পড়া হয় ধীরে সুস্থে। খতম তারাবির ক্ষেত্রে নিয়োগকৃত হাফেজরা এত দ্রুত কোরআন তেলাওয়াত করেন যে অনেক সময় কেবল পঠিত আয়াতের শেষাংশই বোধগম্য হয়। এ ক্ষেত্রে কোরআনের বর্ণ ও শব্দের উচ্চারণও বিকৃত হয়ে যায়। এটি বাঞ্ছনীয় নয়।
আমাদের দেশের কোনো কোনো মসজিদে তারাবির খতম অনুষ্ঠিত হয় মাত্র ২০ দিনে বা তারও কম সময়ে, কোথায়ও ২৫ দিনে আবার কোথাও ২৬ দিন তথা লায়লাতুল কদরের রাতে। দেশের মসজিদে-মসজিদে খতম তারাবির এ বিক্ষিপ্ততা অনেককেই কোরআনের ফয়ুজাত ও বরকত লাভে বঞ্চিত করে। কর্মব্যস্ততা, ভ্রমণসহ নানাবিধ কারণে অনেকের পক্ষেই একই মসজিদে তারাবি আদায় করা সম্ভব হয় না। এটি একটি সমস্যা বটে। এর সমাধানে ইসলামী ফাউন্ডেশন বিগত দুই-তিন বছর ধরেই একটি প্রস্তাবনার কথা বলে আসছে যে, প্রথম রমজানে কোরআনের খতম শুরু হবে। প্রতিদিন দেড় পারা করে প্রথম ছয় দিনে পড়া শেষ হবে ৯ পারা। বাকি দিনগুলোতে এক পারা করে পড়লে ২৭তম দিন তথা লায়লাতুল কদরে কোরআনের খতম হবে। এতে মুসলি্ল সাধারণের অসুবিধা যেমনই দূর হতো তেমনি বজায় থাকত মুসলমানদের জাতিগত ঐক্যের বিষয়টি।
মুহাম্মদ ফরহাদ হোসেন
লেখক : সাবেক কলেজ শিক্ষক
No comments:
Post a Comment